পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

হতাশা বাড়ছে দিন দিন, হারিয়ে যাচ্ছে জাতির জন্য কিছু করার একাগ্রতা


আমি এতদিন আমার প্রতিটি লেখার শেষে লিখতাম, যাই লিখেছি তা আমার ব্যক্তিগত অভিমত, অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। সংযত কারণে এই লেখাটিই আগেভাগেই লিখছি… হয়তো জাতির বিবেকের কাছে এটিই আমার শেষ লেখা।
আমার লেখনি প্রতিভা খুব নগন্য কি না আমার জানা নেই, জানি না আমার লেখাগুলো জাতির বিবেকের কাছে আবেদনময়ী কি না; তবে এটি জানি, আমি  তেমন নামি-দামি কোনো লেখক নই, সখের বশে লিখি, জুম্ম (পাহাড়ি) জাতির দুর্দশা দেখে নিজের বিবেকের দংশনে লেখি ।
কিছুক্ষণ আগে চাকমা ভাষায় প্রচলিত একটা কথা খুব মনে পড়ছিল:
হানা হুমদ পানি ঢালিনেই হোনো লাভ নেই। অর্থাৎ  ফুটো কলসিতে পানি ঢেলে কোনো লাভ নেই।
কারণ আমার সামান্য অভিজ্ঞতা, ভাষা জ্ঞান ও চিন্তাশক্তি দিয়ে লেখা কলামগুলোর কোনো মূল্য দেখি না। জাতিগত নানা সমস্যা নিয়ে লেখার পরেও দেখি, সবকিছু আগে যেমন চলছিলো তেমনই চলছে, কোনো পরিবর্তন নেই। তাই মনে হয়, আমার লেখাগুলোতে হয়তো নেই কোনো প্রতিভার ছাপ; নয়তো ফুটে ওঠে না তেমন আবেদন। অথবা ‌”হানা হুমদ পানি ঢালা না” তিনটির  যে কোনো একটিকে এর কারণ হিসেবে ধরে নিয়েছি।
তবে হ্যাঁ, আমি ভাগ্যবান। কারণ আমি অনেক বন্ধু পেয়েছি, তাদের স্বজাতির জন্য কিছু করার দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। তাদের একজনের কথা উল্লেখ না করে পারছি না– তার নাম প্রিতম চাকমা (প্রীক), সে ReNewable energy Management (Hydropower,Solar, Bio Fuel) Principle of Power System­ ­ নিয়ে পড়াশুনা করছে । ­ ­তার স্বপ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের অশ্রুজলের ওপর তৈরি কাপ্তাই বাঁধকে নিয়ে। সে স্বপ্ন দেখে, কাপ্তাই বাঁধে আরও উন্নত প্রযুক্তি সংযোজন করে সেখান থেকে উৎপন্ন জলবিদ্যুৎ দিয়ে পাহাড়িদের আবাসস্থল আলোকিত করা যাবে।
কাপ্তাই বাঁধের ওপর তার লেখা তথ্যসম্বৃদ্ধ, হয়তো তার লেখাটি আপনাদের অনেকের নজরে পড়েছে।  আমি সম্মান করি তার স্বপ্নকে, সম্মান করি তার ইচ্ছে শক্তিকে। যদিও তার স্বপ্নটিকে বাস্তবায়ন করা বোধহয় কঠিন ।
আমাদের আরো একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা–  জুম্ম সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যম তৈরি করা। হতাশা যতই বাড়ুক, কথা দিচ্ছি, একদিন তা আপনাদের সামনে হাজির করবোই।
এবার আমরা কেনো হতাশ, তার ব্যখ্যায় আসি।
একজন ফেসবুক বন্ধুর প্রোফাইল ছবিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ– পিসিপি’র বর্ষপূর্তীর পোস্টার দেখে আমি তাতে মন্তব্য লিখেছিলাম:
অবিভক্ত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কাম্য।
তিনি উত্তর দিলেন: পিসিপি কবে বিভক্ত হলো ?
আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,  পিসিপি (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রটিক ফ্রন্ট–ইউপিডিএফ), পিসিপি (জনসংহতি সমিতি– জেএসএস) এবং পিসিপি (জেএসএস-এমএন লারমা) এই তিনভাগে কী বিভক্ত নয় ?
উনি উত্তরে লিখলেন, পিসিপি তো পিসিপি-ই, বৃহত্তর নয়, ক্ষুদ্রও নয়, এমএন লারমাও নয়, সন্তু  লারমাও নয় । পিসিপি-র পরিচয় হচ্ছে  পিসিপি। কেউ যদি নিজের ইচ্ছেতে সংগঠন থেকে বের হয়ে আরেকটি সংগঠন গঠন করে, তখন তাকে ওই ধরনের ওই ধরণের নাম লেজ লাগিয়ে  ব্র্যাকেট বন্দী করে লিখতে হয়। পিসিপি-র গঠনতন্ত্র অনুযায়ী  পিসিপি  এক এবং অভিন্ন ।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে আসলেই কী তাই?  তা যদি না হয়, তাহলে কবে বিভক্ত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ অবিভক্ত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে পরিনত হবে?
আমি বাহবা পাওয়ার জন্য লেখি না। কিন্তু এরপরেও আমার লেখা “শিক্ষিত তরুণরাই বদলে দিতে পারে আমাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ঘৃণ্য রাজনীতি” তে একজনের মন্তব্য পাওয়ার পর খানিকটা পীড়িত না পারিনি। এই ব্লগের লেখাটি ফেসবুকে শেয়ার করার পর একজন চাকমা ভাষায় লিখছেন, “আমার আগে ঐক্য দরকার। সেনেট্টেই ইককু মোনদি ফাগাফাগি গোরি হনো লাভ নেই।” অর্থাৎ আমাদের আগে ঐক্য দরকার। সে জন্য এখন ফাঁকা আওয়াজ করে লাভ নেই।
তাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আমার এই লেখাটি কি “ফাকাফাকি”? কোনো প্রতিউত্তর না পাওয়ায় ধরে নিলাম, হয়তো তাই।
কিছু দিন আগে ফেসবুক গ্রুপ CHT BD অথবা “পাহাড়ের রূদ্ধকণ্ঠ CHT Voice” এ  অথবা উভয় গ্রুপেই একটা পোস্ট দেখলাম। তাতে বলা হয়েছে:
কিছু জুম্ম নারী জুম্ম ছেলেদের বন্ধুত্বের অনুরোধ (friend request ) গ্রহণ করেন না (accept), ঝুলিয়ে (pending) রাখেন। অথচ তারা বাঙালি বা বাঙালি নামে কোনো জুম্মর বন্ধুত্বের অনুরোধ (friend request ) পাঠালে তা ঠিকই গ্রহণ করেন (accept)। তিনি নিজেও নাকি  বাঙালি নাম নিয়ে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠিয়ে এমন ঘটনা দেখেছেন।
প্রতিহিংসার বসে নয়,  শুধুমাত্র বাস্তবতা তুলে ধরার জন্যই এই কথাটি লেখা (অনেক খুঁজেও পোস্টটি পেলাম না)।
আমরা যারা ফেসবুক ও ব্লগে যাই, তারা সকলেই লেখাপড়া জানি। সংযত কারণে এইসব শিক্ষিত পাঠকের কাছে আমার প্রশ্ন, লেখাপড়া শিখে আমরা অন্ধ বা দুর্জন হচ্ছি না তো? আমাদের কেনো প্রতিবাদের ভাষা নেই?  সরকার ও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিনিয়ত অগণতান্ত্রিক কাজ করে যাচ্ছে। কোনো আমারা তার প্রতিবাদ করছি না?
যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত হয়েও আমরা আজ কেনো প্রতিবাদহীন? পাহাড়ে ভাতৃঘাতি  সংঘাতের পাশাপাশি সেখানে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক পাহাড়িদের জমি জবর দখল, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ধর্ষণসহ আরো নানা নিস্পেষণ। কিছুদিন বিরতির পর পর আবারো এ সব ঘটনা ঘটেই চলেছে।
এ কথা ধারণা করা কঠিন নয়,  যতদিন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হবে, ততদিন এসব অমানবিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। … একদিন আমার উপর বা আমার বাবা-মা, ভাই-বোনদের উপর একই রকম হামলা যে হবে না, এ রকম নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
এর পরেও কী আমরা শুধু নিরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করে যাবো? একদিন তো মরতেই হবে, তাহলে লড়াই করে কেনো মরবো না?
আবারো সেই বন্ধুটির প্রসঙ্গ। একদিন মাঝ রাতে হঠাৎ করে সে ফোন করে দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলে:
ভাই, বাংলাদেশে থেকে কোনো লাভ নেই! তুই যে লেখালেখি করিস, তাতেও কিছু হবে না। অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। কোনো ঐক্য নেই। নেই  জাতির জন্য জোর কোনো আন্দোলন। বন্ধ হচ্ছে না ভাতৃঘাতি সংঘাত। সবাই শুধু নিজের স্বার্থটাই ভাবে। জাতির কী হবে,  কী হচ্ছে — তা চিন্তা করে না। … তুই বরং ভারতে চলে আয়। এখানে অন্তত নিজের ভাইয়ের আঘাতে প্রাণ হারাবি না!
ভেবে দেখুন, কিছুদিন আগেও যে যুবক স্বপ্ন দেখতো কাপ্তাই বাঁধে উন্নত প্রযুক্তি সংযোজন করে আলোকিত করবে পাহাড়, আজ সে কেনো হতাশ?… 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন