পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

স্মৃতিচারণা এবং ......

ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়েই লেখাটি শুরু করছি । আমি প্রতিভাস চাকমা, বাবা প্রয়াত চন্দ্রশেখর চাকমা, যার অভাব আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করি । যতটা না বাবা হিসেবে তার চেয়ে বেশি হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে । যাকে আজ কাছে পেলে হয়তো জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতে পারতো কিংবা অনেক কিছুর ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, সমাধান এবং পরামর্শ তার থেকে নিতে পারতাম । পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে আমার ভাবনা আমার স্বপ্নটা যদিও ছোটকাল থেকে কিন্তু মন থেকে অনুভব করতে শিখেছি ২০০৯ সালে । যে দিনটিতে তিনি বাসার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন । কে বা কারা কিংবা কারা বা কাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে এই ঘটনাটি ঘটেছিল তা আমার অজানা নয় । সেদিন মনে ছিল ক্ষোভ, দুঃখ, তবে আজ তা শুধুই কষ্টের যতটা না বাবাকে আঘাত করার কারণে তার চেয়ে বেশি জাতির অবক্ষয়তার কারণে । সেটাই যদি শেষ হতো তাও হয়তো নিজেকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা খুজে পেতাম । কিন্তু যেদিন বাবা মারা গেলেন খাগড়াছড়িতে ( অথচ আমাদের বাড়ি রাঙ্গামাটিতে ) না দেখে যেতে পারলেন পরিবার, না বাড়ি না হাসপাতাল । তারপর !! ১১ই অগাস্ট, ঘটনাটি ভুলে থাকতেই চেষ্টা করি, যিনি দেহ ত্যাগ করেছেন, যিনি কিনা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ইতিহাসের একমাত্র সাধারণ সম্পাদক যিনি তিন তিন বার দায়িত্ব পালন করেছিলেন তার সাথে তার সহকর্মীরা শেষ দেখা করতে এলে বাধা দেওয়া, হুমকি দেওয়া হলো তারা রাঙ্গামাটি ত্যাগ না করলে দাহ করতে দেওয়া হবে না, আমার বাবাকে !! জানিনা আমি কিভাবে নিজেকে সংযত রেখেছিলাম !! বাবার নামে দেয়ালিকা, বাবা সংস্কারপন্থি, দলত্যাগি,সার্থলোভী আবার অনেকের কাছে একজন সত্যিকার নেতা । আজো জানা হয়ে উঠেনি কারণগুলো । বাবার নামের পাশে দেওয়া প্রলেপগুলো কিংবা বাবাকে নিয়ে করা কটুক্তিগুলো ঠিক বিশ্বাসো করতে পারিনা বা অসমর্থনও করি না । যদি কোনোকালে বড়বাবা ( রূপায়ন দেওয়ান ) আর আজু ( সন্তু লারমা ) এক মঞ্চে জণসমক্ষে যদি মুক্ত বিতর্ক করেন তখন হয়তো জানতে পারবো আসল ঘটনা । তবে আমার কাছে বাবা বাবাই, খারাপ হোন ভাল হোন , এবং অনেকের মাঝে একজন যিনি আমার আদর্শ । আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর অবতারণা এই কারণে যে প্রথমত আজ আমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী এবং দ্বিতীয়ত ভ্রাত্রিঘাতি সংঘাতের কারণে সৃষ্ট সংকটময় পরিস্থিতি বুঝাতে । সঠিক পরিসংখ্যান আমার জানা নেই, তবে যতটুকু জানি , শান্তিবাহিনীর আমলে সেনাবাহিনীর হাতে যতজন না শহীদ হয়েছেন তার চেয়ে বেশি প্রাণ হারাচ্ছেন ভ্রাত্রিঘাতি সংঘাতে । ভ্রাত্রিঘাতি সংঘাতে কে লাভবান তা আজো জানা হয়নি । পত্রপত্রিকা, ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি ইউ পি ডি এফ বার বার সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে অন্যদিকে জে এস এস ইউ পি ডি এফ কে নিষিদ্ধ করার আন্দোলন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত । ইউ পি ডি এফ কে ধন্যবাদ এই কারণে যে তারা মুখে অন্তত আহ্বান জানিয়েছে জানাচ্ছে, তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তাদের এই আহ্বান লোক দেখানো বলেই প্রতিয়মান হয় । অন্যদিকে জে এস এস এম এন লারমা যদিও প্রথম থেকে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন, আমার জানামতে তাদের আঘাটে কেউ প্রাণ হারিয়েছেন শুনিনি কিন্তু প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে লারমা বাবুকে দোষারোপ করার মাধ্যমে তারা কতটুকু সফল তা আমি জানি না , হয়তো তারা মনে করেন সৎ সঙ্গে সর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ কিংবা অন্যায় যে করে আর যে সহে দুজনেই সমান অপরাধী । এই ক্ষুদ্র মস্তিস্কে তা আমার বুঝা হয়ে উঠেনি ।
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেয়, ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার সময় , বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে কিংবা চুক্তি কোন সিদ্ধান্তটিতে আমরা এক ছিলাম !! জানি এবং মানি সেগুলো জুম্ম জনগণের মঙ্গলের জন্যই । কিন্তু আদৌ মঙ্গল বয়ে এনেছে কি !! আমার বন্ধুর সেই উক্তিটির সাথে আমি একমত, যে রাজনীতিবিদরা হচ্ছেন মাছ আর জনগণ হচ্ছে পানি । জনগণের সতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আন্দোলন জয় লাভ করতে পারে না, যেমনটা আদিবাসী ইস্যুতে । আমরা আন্দোলন করছি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির জন্য, আবার আমাদের মধ্যেও অনেকে আদিবাসী পরিচয় চান না ।
আমার জানা মতে, তাদের সংখ্যাটা এত বেশি না যারা পারিবারিক শিক্ষা পেয়েছিলাম, আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার অধিকার আমার । যদি পেতামই সেই দিদি ( সংগত কারণে নামটি উল্লেখ করলাম না ) চাকমাদের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখতেন না চাকমারা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি, কিংবা আত্মমর্যাদা থাকলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনস্টিটিউট এ কর্মরত থাকতাম না বা আমাদের কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে লিখতাম না স্থানীয় ও উপজাতিয় পোশাক বিক্রেতা । আজ আমাদের তরুণ প্রজন্ম এবং ধনবানরা রাজনীতি বিমুখ । তাদের মতে রাজনীতি করে কি হবে , হয় নিজে মরবো নয়তো জাতি ভাইকে মারতে হবে , তারচেয়ে চুপচাপ আছি এই ভালো । কিংবা ধনবানরা অতিষ্ঠ , একদলকে চাদা দিলে অন্য দল দাবি করে বসে দ্বিগুণ । তাদের মতে হয়তো এই প্রবাদতায় সত্য, দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভাল । আমি তাদের মতামতকে শ্রদ্ধা রেখে বলতে চায় নায় মামার চেয়ে কানা মামা ভালো, দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ । বাঘাইহাট, খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা, নানিয়াচরের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কি আছে ?? কিংবা জালিয়াপাড়ার সেই ঘটনাটির মতো একদিন আমারও ওভাবে রক্ত ঝরতে পারে, আমার আপন মা বোন সম্ভ্রম হারাতে পারে কোনো সেটেলার বাঙ্গালীর হাতে, নয়কি ?? তবে কেন আমার মাঝে জাগ্রত হবে না জুম্ম জাতীয়তাবাদ, কেন আমি আমার অধিকারের জন্য আন্দোলন করবো না !! কিংবা যারা জুম্মজাতিয়তাবাদে উদ্ভুদ্ধ হয়ে কাজ করছি তারা কেন ভ্রাত্রিঘাতি সংঘাতকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করছি , এম এন লারমা বলেছেন কাউকে প্রাণে মারা যায় কিন্তু হারানো প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া যায় না, সত্যিকার জুম্মজাতিয় সৈনিক কখনো কি ভ্রাত্রিঘাতি সংঘাতের পক্ষে হতে পারে ?? আমি না হয় মূর্খ, নাম করা কোনো প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করছি না বা ভালো কোনো ডিগ্রি আমার নেই, কিন্তু আপনারা তো অনেকেই ভালোভালো প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন, পড়ছেন, শুধু কেন সেখানো বুলি আওড়াবো । আসুন নিজেকে একটু বিস্তৃত করি । সর্বোপরি এত এত বার আহ্বান জানানোর পরও যেহেতু ভ্রাত্রিঘাতি সংঘাত কেউ বন্ধ করছেন না, আসুন সুশীল সমাজের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নেতৃত্বে আমরা তরুণ সমাজ দলে দলে একই পতাকাতলে একই মত্তে ব্রত হয়ে স্বপ্নের জুম্মলেন্ড গড়ে তুলি । আমার মা বাবা হয়তো আমাকে অধিকার সচেতন করেন নি, আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষকে করি অধিকার সচেতন, বাচিয়ে রাখি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আমরা নিজেদের মাতৃভাষায় শিক্ষিত হতে পারিনি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন নিজেদের মাতৃভাষায় শিক্ষিত হতে পারে সেই পরিবেশ তৈরি করি ।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন